১৭ ই জানুয়ারী: A wedding day
জানুয়ারী মাস ২০১৪ সাল। বিতকির্ত এক তরফা নির্বাচন পরবর্তী সময়; যখন পুরো দেশটা সহিংসতায় উত্তাল, বেসামাল ও টালমাটাল। ঢাকার পরিস্থিতি তখন ভয়াবহ অবস্থা। ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে চলছি।
একদিন সন্ধ্যায়, ধানমণ্ডি-১৫ তে হঠাৎ ককটেল বিস্ফোরণ হয়। সেইসাথে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। আমি দৌড়ে কেএফসির পাশে একটি এটিএম বুথের মধ্যে ঢুকে পড়ি। প্রাণ রক্ষাতে গাদাগাদি করে ভিতরে চুপসে ছিলাম অনেকক্ষণ। এরকমই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আমার জীবনযুদ্ধও চলছে।
মিরপুরে ডিজিল্যাবে আমার চাকরি হয়েছে। হাতে সময় নিয়ে জয়েন্টও করেছি। কাজী ফার্ম লিঃ এর দীপ্ত টিভি'র রাইটিং ওয়ার্কশপে ট্রেনিং করছি। আবার বর্তমান চাকরিটাও করছি।
প্রচন্ডরকম ব্যস্ততা। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে দৌড়ে দীপ্ত টিভির রাইটিং ওয়ার্কশপে যেতাম। সেখান থেকে বের হয়ে তিনটায় ছুটে অফিসে যেতাম। অফিস শেষে রাত এগারোটায় বাসায় ফিরে চারটে ডালভাত নাকেমুখে দিয়েই ল্যাপটপ নিয়ে বসতাম। রাত জেগে দীপ্ত টিভির এসাইনমেন্ট তৈরি করতাম।
মাথার উপর প্রচন্ডরকমের চাপ। খাচ্ছি ডান হাতে, কাজ করছি বাম হাতে। বাথরুমেও যাচ্ছি ল্যাপটপ নিয়ে। দম ফেলার সময়ও নাই। দেশটার মতই আমারও অবস্থা বেসামাল, টালমাটাল।
বর্তমান চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার জন্য অফিসের এডমিন ম্যানেজারের কাছে রিজাইন লেটার দিলাম। স্যার আমার রিজাইন লেটার গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিলেন। সরাসরি রিজাইন লেটার গ্রহণ না করায় চুপিসারে স্যারের অনুপস্থিতিতে তার রুমে রিজাইন লেটারটা রেখে আসি। রিজাইন লেটার দিয়ে মনে হলো, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ঠিক সেই মুহুর্তে আরও একটি চাপ ঘাড়ের উপর এসে পড়ে। অবস্থা এমন, খোদা তুমি উপর থেকে দড়ি ফেলাও, আমি উঠে আসি। এতো চাপ আর নিতে পারছিনা।
আমার বিয়ের জন্য মা বাবা একটি মেয়ে পছন্দ করেছে। তার কিছু ছবি আমাকে মেইলও করেছে। ব্যস্ততায় সেই ছবিগুলো দেখা হয়নি। দুপুরের পর ফোনটা অন করতেই বাড়ি থেকে ছোট ভাইয়ের কল আসে। রিসিভ করতেই বললো, তোর ফোন বন্ধ ক্যান? বললাম, ট্রেনিং এ ছিলাম। সকাল থেকে ফোন দিচ্ছি, ফোন বন্ধ। কেন? কি হয়েছে? তোকে যে ছবিগুলো পাঠাইছি, দেখেছিস? না দেখি নাই। রাতে বাসায় গিয়ে দেখবো। রাতে না। তুই এখুনি দেখে জানা। ঠিক আছে, জানাচ্ছি। বলে ফোন কেটে দিলাম।
ছবি দেখার জন্য বাসায় গেলাম। সেসময় আমি মডেম দিয়ে নেট চালাইতাম। বাসায় এসে রুমে ঢুকতে পারলাম না। সাধারণত এসময় আমি বাসায় ফিরি না। তাই হয়ত ফ্ল্যাটে আমার রুমমেট ব্যক্তিগত তালা তার রুমের না মেরে সদর দরজায় লাগিয়ে বের হয়ে গেছে।
ছবিগুলো আর দেখা হলো না। বাড়ি থেকে একেরপর এক কল আসছে। আমি ফোন ধরছি না। একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করি। তারপর জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম।
জীবনের চাওয়া না পাওয়া, চড়াই উৎড়াই, ঘাত প্রতিঘাতের হিসাব মেলাতে শুরু করি। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে। অধরা স্বপ্নের মত ছিল আমার জীবন। শুধু কল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাস্তবে ছুয়ে দেখতে পারি নাই। কারণ, আমি সাধ্যের বাহিরে যেতে পারিনি।
প্রচন্ড জিদ নিয়ে ঢাকার শহরে আসি। চাকরি শুরু করি। শুরুতে চাকরি করে যা বেতন পেতাম, তা দিয়ে নিজের চলায় কঠিন ছিল। তারপরও ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ দিতাম। ভাই আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। কিছু খেতে গেলে ওর কথা মনে পড়তো। না খেয়ে জমিয়ে রাখতাম টাকা। তাই সকালের নাস্তার বেশিরভাগই ছিল কখনো একটা বিস্কুট, কখনো শুধুই একগ্লাস পানি। এভাবে নিজেকে একটু একটু তৈরি করেছি।
ভাবতেই চোখটা ছলছল করে উঠে। চোখ দুটি মুছে মুছলাম। নন-সিনেমাটিক জীবনের অবজ্ঞা ও অবহেলার মানুষটি, আজ কোনমতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখে গেছে। তাই, নিজেকে ঠকিয়ে লাভ কী?
পরিবারের সবাইকে একে একে কল দিলাম। সবার সাথে কথা বলে সবশেষে বাবাকে ফোন দিলাম। বাবার সাথে কথা বলে তারপর মায়ের সাথে কথা বলি। মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে শুনে আমি আর দেখার প্রয়োজন মনে করি নাই। চোখ বুজে রাজি হয়ে গেলাম।
অফিসের লিফটের সামনে এডমিন ম্যানেজার স্যারের সাথে দেখা। আমাকে রুমে দেখা করতে বলেন। আমি 'জ্বী আচ্ছা' বললাম। পরে ব্যস্ততায় দেখা করা হয়নি।
সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি ঘটবে বুঝি নাই। বিকেল ৫টায় সম্মতি দিলাম। রাতে ৮টায় বাড়ি থেকে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দেয় আগামী সপ্তাহে বিয়ে। এর কিছুক্ষণ পরই এডমিন স্যার ফোন করে বলে, আমার রুমে আসেন। আমি স্যারের রুমে গেলাম। স্যার আমাকে রিজাইন লেটার উইথড্র করে বেতন বৃদ্ধির এপ্লিকেশন দিতে বলেন। আমি আমার শর্ত মোতাবেক, ঐরাতেই রিজাইন লেটার উইথড্র করে বেতন বৃদ্ধির এপ্লিকেশন দিলাম।
গ্রামের মুরুব্বীদের মুখে শুনেছি, পুরুষ মানুষ তিনবার জন্মলাভ করে। এক. মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠের দিন। দুই. প্রথম বেতন পাওয়ার দিন। তিন. বিবাহের দিন।
সে-ই সুত্র মতে, আজ আমার তৃতীয়তম জন্মলাভের দিন।
'১৭ই জানুয়ারি' এই দিনে আমি যে মায়ার বাঁধনে আঁটকেছি, সে বাঁধন আল্লাহপাক যেন আমৃত্যু পর্যন্ত অটুট রাখে।।
Comments
Post a Comment
আপনার মূল্যবান মতামত দিন