এক অসহায় বাবা
![]() |
এক অসহায় বাবা |
বাসা থেকে বের হচ্ছি, হঠাৎ ধপাস করে হাত ফসকে তালাচাবি মেঝেতে পড়ে ছিটকে গেলো। আমি তালাচাবি কুড়িয়ে হাতে নেড়েচেড়ে নষ্ট হয়েছে কি-না চেক করলাম। তারপর বাসায় তালা লাগিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলাম।
হুট করে এমন কেন হলো? সেটা বুঝতে পারলাম, তার কিচ্ছুক্ষণ পরই। রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠছি মাত্র, চাচাশ্বশুর ফোন দিলো। রিসিভ করতেই বলেন, নওরিন হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মুখ দিয়ে ফেনার মত লালা বের হচ্ছে।
আমি প্রচন্ডরকম শক খেলাম, আমার দু'বছরের বাচ্চা মেয়ের এমন খবর শুনে। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলে অফিসে গেলাম। অফিসের ম্যানেজার স্যারকে বলেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম।
ফোনে খোঁজখবর নিচ্ছি আর কাঁদছি। এছাড়া অসহায় বাবার আর কিছু করার নাই। রাস্তায় কিছুটা জ্যাম থাকায় বাস থেকে নেমে পাগলের মত দৌড় দিলাম। টেকনিক্যাল মোড়ে এসে দূরপাল্লার বাস কাউন্টারে টিকিট কেটে রানিং বাসে চড়ে বসলাম।
পাবনা সদর হাসপাতাল থেকে আমার বাচ্চাকে রাজশাহী অথবা ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেছে শুনে আমার অবস্থা পাগল প্রায়। বুক ফেটে কান্না হুহু করে বের হচ্ছে। আমি পাগলের মত কাঁদছি আর ঝড়ে বিধস্ত পাখির মত শুধুই ছটফট করছি।
দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখিয়ে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যেতে বললাম। যেহেতু রাজশাহী কাছে আর আমি সরাসরি রাজশাহী যাওয়ার জন্য পাবনাগামী বাস ছেড়ে দিলাম।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমার বাচ্চাকে দেখে বলেন, মাইল্ড স্ট্রোক। এটুকু বাচ্চার এমনটি হতে পারে? আল্লাহপাক আমায় কি পরীক্ষার মধ্যে ফেললো? ভাবতে ভাবতে আবারও হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আশেপাশের মানুষজন শুধু চেয়ে দেখছিল, এক অসহায় বাবার গগণবিদায়ী আর্তনাদ।
স্ট্রোকের কথা শুনে রাজশাহী না ঢাকা আগারগাঁওয়ে নিউরোসাইন্সেস হাসপাতালে নিয়ে আসতে বললাম। এম্বুলেন্স ঢাকার উদ্দেশ্যে দেয়। আমাকে ঢাকায় থাকতে বলে কিন্তু আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল ভয়ানক টেনশনে। একপলক বাচ্চাকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল।
আমিও রওনা দিলাম। পথ যেন ফুরায় না। সে এক দূর্বিষহ জার্নি। ফুড ভিলেজে এসে বাস থেকে নেমে আমার বাচ্চার সঙ্গে এম্বুলেন্সে আবার ঢাকায় রওনা দিলাম।
রাত বারোটায় নিউরোসাইন্সেস হাসপাতালে পৌছায়। পরিচিত লোক থাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা দ্রুতই পায়। পরীক্ষানিরীক্ষা করে স্ট্রোক বা ব্রেনে আঘাতজনিত কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। তবে এটা কেন হলো? সেটার জন্য একমাস অবজারভেশনে রেখে, একমাস পর আবার কিছু টেস্ট করে হাসপাতালে দেখা করতে বলেছে।
ঢাকা নিউরোসাইন্সেস হাসপাতাল যেখানে প্রধানমন্ত্রীর মত ভিআইপি'ও ট্রিটমেন্ট নেন সেখানে এমন ভুল কিভাবে হয়? আমার বুজে আসেনা! আমিও টেনশনে রিপোর্ট খেয়াল করে দেখি নাই।
গত ১৪ তারিখে নিউরোসাইন্সেস হাসপাতালের রিপোর্টগুলো নিয়ে আমার বাচ্চাকে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বলে, সিটি স্ক্যান রিপোর্ট ভুল। সিটি স্ক্যানের ফিল্মের সাথে রিপোর্টের মিল নাই। ভুল করে আরেকজনের রিপোর্ট দিয়ে দিছে।
আমি মেডিকেল লাইনে দীর্ঘদিন চাকরি করছি। আমার রিপোর্টটায় যদি এমন হয়। তাহলে বুঝার আর বাকি থাকেনা। সরকারী হাসপাতালে নন-মেডিকেল পার্সনের রিপোর্ট কেমন হয়?
যাইহোক, পুরনায় রিপোর্ট করার জন্য সিটি স্ক্যানের ফিল্ম নিউরোসাইন্সেস হাসপাতালে দিয়ে আসি। শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাচ্চার ব্লাডের কিছু টেস্ট দিয়েছিল। সেই টেস্টগুলো করে রিপোর্ট দেখে তব্দা খেয়ে গেলাম।
আমার বাচ্চার শরীরে রক্ত নাই। Hb 6.30 g/dL. আমি সাথেসাথে ব্লাড আবারও চেক করি। বরাবর একই রেজাল্ট। বেশ কয়েকজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে রিপোর্ট নিয়ে কাউন্সিলও করেছি।
আমার বাচ্চার এখন এ্যানিমিয়ার ট্রিটমেন্ট চলছে। যেটা কম্বাইন্ড ডেফিসিয়েন্সি এ্যানিমিয়া। শরীরে ক্যারিয়ার 'ই ট্রেইট' বা থ্যালাসেমিয়া আছে কি-না তা পরীক্ষার জন্য বাচ্চার ব্লাড আজকে বাসা থেকে কালেক্ট করে আমাদের হেড অফিসের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
আগামীকাল রাত নয়টায় রিপোর্টটা দিবে। খুবই টেনশন আছি। Hb electrophoresis রিপোর্টটা যেন নরমাল আসে। সবার কাছে করজোড়ে দোয়ার দরখাস্ত রইল আমার সোনা মামনির জন্য।।
Comments
Post a Comment
আপনার মূল্যবান মতামত দিন