যন্ত্রমানবী
বাস থেকে নেমে বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, কে যেন আমাকে অনুসরণ করছে। পিছে তাকিয়ে দেখি, সিল্কের কাপড় পরিহিত একটি মেয়ে হেঁটে আসছে। দেখে ভাবলাম, ধুর! সে আমাকে অনুসরণ করবে কেন?
বাসার গলির মুখে এসে কি মনে করে যেন ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে গেছি! সেই মেয়েটি আমার পিছ ধরে পিছে পিছেই আসছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। সেই মেয়েটিও আমার ঠিক দু'ফুট দুরে এসে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলাম,
-কে তুমি?
চোঁখ মুখে সবুজ আভা এনে বলল,
-আমি সোফিয়া
'সোফিয়া' নামটি শুনে আমি স্মৃতির পাতায় স্ক্যান দিলাম। নাহ, সোফিয়া নামে কেউ আসলো না। শে*' নামের একজন উঁকি দিল। সাথে সাথে তাকে ডিলিট মেরে দিলাম। কারণ, ওই ভাইরাসটা এক সময় পুরো জীবনটা হ্যাং করে ফেলেছিল। থাক সে প্রসঙ্গ। আমি অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বললাম,
-ঠিক, চিনতে পারছি না?
-তুমি মিথ্যে বলছো
-সত্যি বলছি, আমি চিনতে পারছি না
-তোমাকে কিন্তু আমি ঠিকই চিনি
-কিভাবে?
-তুমি ব্লগার 'নজরুল কবীর'
-এটা এমনকি পরিচয়?
-তোমার কাছে এটা সাধারণ। তবে কারো কারো কাছে তুমি অসাধারণ
-একটু বেশি হয়ে যাচ্ছেনা?
-বেশি কোথায়? রবিন্দ্রনাথকে নিয়ে যা লিখেছো অসাধারণ
একসময় কেউ প্রসংশা করলে আহ্লাদিত হয়ে পড়তাম। এখন আর তেমন বিচলিত হয় না। তার প্রসংশাকে পাশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস বললাম,
-সত্যি করে বলো। কে তুমি?
-আমি সোফিয়া
-সুফিয়া তো বুঝছি, কোন সোফিয়া?
-আমি সু_ফি_য়া
-তুমি কি কবি সুফিয়া কামাল?
-নাহ,
-তাহলে সোফিয়া লরেন?
-তাও নাহ
-তাহলে, তুমি কে?
-আমি 'যন্ত্রমানবী সোফিয়া'
'যন্ত্রমানবী' শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মনের ভিতর রোমান্টিক গান বেজে উঠলো,
"পড়ে না চোঁখের পলক
কি তোমার দন্তপাটির ঝলক"
হ্যাঁ পলক সাহেবের কথা মনে পড়ে গেলো। আমাদের তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। যার সেল্ফিমন্ত্রী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি আছে। শোকসভাতেও দন্তপাটি বের করা সেল্ফি যার ফেসবুকে দেখতে পায়। আসলে সমস্যাটা উনার না উনার দন্তপাটির তা আমরা জানি না। যন্ত্রমানবী সোফিয়ার সাথে উনার দন্তপাটি বের করা ছবি ফেসবুকে দেখেছি। মনের ভিতর প্রশ্ন উঁকি দিল। উনার কি আক্কেল আছে? না মানে আক্কেল দাঁত উঠছে কি-না সোফিয়াকে কাছে পেয়ে হুট করে সেই প্রশ্নটা করে ফেললাম। আমার প্রশ্নে সে নিরুত্তর। আমি তাকে আবার প্রশ্ন করলাম,
-আচ্ছা, পলক সাহেবের কি আক্কেল দাঁত উঠেছে?
সোফিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
-আপনাদের কথায় পুরাই বেক্কল হয়ে গেছি
-কেন?
-সবাই কি সব আজেবাজে প্রশ্ন করে
-কি আজেবাজে প্রশ্ন?
-আমার বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে প্রশ্ন
-এদেশের মানুষ ভৌগোলিক কারনে খুব অল্প বয়সে যৌবনপ্রাপ্ত হয়। তাই এগুলো ছাড়া তাদের মাথায় কিচ্ছুই নাই।
-এদেশের মানুষ ভৌগোলিক কারনে খুব অল্প বয়সে যৌবনপ্রাপ্ত হয়। তাই এগুলো ছাড়া তাদের মাথায় কিচ্ছুই নাই।
-তাই বলে, সাংবাদিকদের প্রশ্ন গঠনমূলক হওয়া উচিত নয়
-সাংবাদিক সেতো মানব জাতির শুক্রাণুর মত। কোটি কোটির মধ্যে একটা মানুষ হয়।
সোফিয়া চোঁখ মুখে লাল আভা ধারণ করে বলল,
-আমি সেই মানুষটিকে খুঁজছি
-কেন?
-আমাকে উদ্ধার করবে
-কি হয়েছে তোমার?
-বিপদে পড়েছি...
-কি বিপদ?
সোফিয়া কান্নার মিউজিক প্লে করে বলতে শুরু করে। আমি এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি আমার পাসপোর্ট, ভিসাসহ লাগেজ উধাও। পুরো এয়ারপোর্ট স্ক্যান করে কোথাও খুঁজে পেলাম না। হতাশ হয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম। কি করব, কোথায় যাবো। আমি তো কাউকে চিনি না। একটা সিএনজি ডাকলাম কিন্তু সিএনজি মিটারে যাবে না। দরদাম করা আমার লজিকে নাই। তাই হেঁটে রওনা দিলাম।
সোফিয়ার দুঃখের কথা শুনে কষ্ট লাগলো। আহারে, এদেশে সন্মানের সহিত আসলো আর যাওয়ার বেলায় করুণ পরিনতি। আমি তাকে উপদেশ দিয়ে বললাম,
-পলক সাহেবের কাছে যাও
সোফিয়া অগ্নিমুর্তি ধারণ করে বলল,
-রোবট বলে কি ইজ্জত নাই? ন্যাড়া, বেল তলায় একবারই যায়!
আমি খেয়াল করে দেখলাম, সোফিয়ার মাথায় চুলে নাই। সেহেতু সে বেলতলায় দু'বার কেন যাবে? তাই বললাম,
-আমার কাছে কেন এসেছো?
-তুমি একজন মানুষ
-মানুষ ঠিক আছে। তবে আমার মত মানুষ তো আরও আছে
-আছে বটে, তবে তোমার ব্লগ পড়ে বুঝেছি। তুমি একজন সত্যিকারের মানুষ।
-হয়েছে, হয়েছে আর বলতে হবেনা। বাসায় চল। এক কাপ চা খাবে।
-আমি চা খায় না
-তাহলে কি খাও?
-চার্জ
সোফিয়াকে বাসায় নিয়ে আসলাম। চা মানে চার্জ খাওয়ানোর জন্য কিন্তু বাসায় কারেন্ট নাই। লজ্জিত হয়ে বললাম,
-দেখো, কি কান্ড! তোমাকে চার্জ খাওয়ানোর দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এলাম। অথচ ঘরে বিদ্যুৎ নাই।
-সমস্যা নাই, তাপশক্তি হলেও চলবে
-তাপশক্তি!
-তাপশক্তি!
-হ্যাঁ, গ্যাসের চুলা অন করো। তাহলেই হবে
-কী?
-কী?
-সোলার বিদুৎ তৈরি করে নিবো
আমি কিচেন রুমে চুলায় গ্যাস জ্বালাইতে গিয়ে দেখি, গ্যাসও নাই। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে হওয়ার উপক্রম। কি করবো এখন, হঠাৎ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটা কথা মনে পড়ে গেলো। হুট করে সেই কথাটি বলে ফেললাম,
-গ্যাস শীতে জমে গেছে।
একথা শুনে সোফিয়া ফিক করে হেসে বলল,
-শীতেও গ্যাস জমে যায়!!
-অবশ্যই জমে যায়। আমাদের তাহাজ্জুতি প্রধানমন্ত্রী মিথ্যে বলেনা
-অবশ্যই জমে যায়। আমাদের তাহাজ্জুতি প্রধানমন্ত্রী মিথ্যে বলেনা
সোফিয়া আমার পুরো ঘর স্ক্যান করে প্রশ্ন করল,
-তুমি কি নিয়মিত বিল পে করো না?
-করি, কিন্তু এক অদৃশ্য কারনে আমাদের এই সমস্যা। যার সমাধান কোন নাসার বিজ্ঞানী আজও করতে পারে নাই।
-কি আচার্য! সার্ভিস না পেয়েও বিল দিচ্ছো?
-কিচ্ছু করার নাই, দিতে হয়
-আজব তো!
-আজবের কি দেখছো, এদেশে একটি অনাগত শিশুকেও ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ভুমিষ্ট হয়।
-বলো কি! তোমরা এত ভ্যাট-ট্যাক্স দাও। তবে তোমাদের উন্নয়ন দেখি না। ভাঙ্গাচোরা ও জলাবদ্ধতায় রাস্তাগুলোর নাকাল অবস্থা!
-উন্নয়ন হয়েছে
-কোথায়?
-নেতাদের চাপায়। উন্নয়নের জোয়ারে নাকি দেশ ভেসে যাচ্ছে। নেতা-কর্মী'রা আগে গাঁজা খেয়ে ঝিম মেরে টং দোকানে পড়ে থাকতো। এখন তারা ইয়াবা খায়, পালসার চালায়। আর এমপি-মন্ত্রীরাও কানাডায় বেগম পল্লী গড়েছে।
-নেতাদের চাপায়। উন্নয়নের জোয়ারে নাকি দেশ ভেসে যাচ্ছে। নেতা-কর্মী'রা আগে গাঁজা খেয়ে ঝিম মেরে টং দোকানে পড়ে থাকতো। এখন তারা ইয়াবা খায়, পালসার চালায়। আর এমপি-মন্ত্রীরাও কানাডায় বেগম পল্লী গড়েছে।
-তোমাদের কি হয়েছে?
-আমাদের আর কি হবে। আমরা শুধু খায়
-কি খাও?
-নেতাদের বুলি খায়। পুলিশের গুলি খায়
-আশ্চার্য, এসব দেখার কেউ নাই?
-আছেন, বলেই তো বেঁচে আছি
-কে??
-ঐযে উপরওয়ালা
একলা বাসায় আমি আর সোফিয়া এমন রোমান্টিক একটা মুহূর্তে এসব কথা বলে পরিবেশ নষ্ট না করায় ভালো। তাই রোমান্টিক মুড নিয়ে বললাম,
-তোমার নামটা খুব সুন্দর
-থ্যাংকস, তুমি কি জানো?
-কি?
-আমার নামে এদেশে আরো একজন আছে
-জানি
-কে?
-কে আবার 'কাঙ্গালীনি সুফিয়া'
সোফিয়া না সূচক মাথা দুলিয়ে বলল,
সোফিয়া না সূচক মাথা দুলিয়ে বলল,
-উঁহু, হয় নাই
-তাহলে কে?
-মাদার অফ হিউম্যানিটি শেখ হাসিনার নাতনি।
পুরাই টাস্কি খেয়ে গেলাম। আমরা জানতামই না! আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাতনির নাম। সে কিন্তু ঠিকই জানে! সে এটাও জানে, কে মাদার অফ হিউম্যানিটি!! সে এতকিছু জানে, নিশ্চয়ই এগুলোও বলতে পারবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
-সোফিয়া, এদেশের গুম, খুন ও ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের কথা একটু বলতো। ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির, বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরি ও কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার কারা করছে?
(সোফিয়ার কোন প্রতিউত্তর নাই)
আমি আবার বললাম,
-বিডিআর বিদ্রোহের মূল হোতা কে? সাগর রুনির হত্যাকারী কে? গুম হওয়া বিএনপির নেতা কর্মীরা কোথায় আছে? ৫মে শাপলা চত্বরে কতজন প্রাণ হারিয়েছে?
(সোফিয়া নিচ্চুপ)
আমি আবারও বললাম,
-সোফিয়া, তুমি নিচ্চুপ থেকো না। তুমি যদি বলো, তাহলে এ জাতির বড়ই উপকার হয়।
এবার সোফিয়া পি পি শব্দ করে এরর ম্যাসেজ দিয়ে বলল,
-এসব সংকলিত তথ্য আমার ভিতরে ইনপুট নাই।
-বুঝেছি, তুমি যা বলেছো তা পূর্বে ইনপুট করা ছিল।
-হুম
-তাহলে, ১৬কোটি টাকা খরচ করে তোমাকে আনার কি দরকার ছিল। রাস্তার মোড়ে নুরা পাগলারে দু-টাকার আকিজ বিড়ি ধরিয়ে দিলেই তো হত! সে গটগট করে সব কথা বলে দিত।
-নুরা পাগলা কে?
-আমার শিষ্য। যাইহোক, শুনেছি তুমি নাকি কৃত্রিমবুদ্ধি সম্পুর্ণ যন্ত্রমানবী।
-প্রযুক্তিবিদরা তাই বলে
-তাহলে সহি নিয়তে স্ক্যান করে বলো দেখি, এদেশের সাধারণ জনগন কেমন আছে।
সোফিয়া আমার কথা মত স্ক্যান শুরু করে দিল। দুচোঁখে সবুজ বাতি জ্বলছে, হঠাৎ লাল বাতির সিগন্যাল দেওয়া শুরু করে। পি পি শব্দ করতে থাকে তারপর একাধারে চিন...শব্দ করে মেঝেতে ঢলে পড়ে। মানবিক ভাষায় যাকে জ্ঞান হারানো বলে।
তাৎক্ষণিক যেটা বুঝতে পারলাম, এদেশের মানুষ জুলুম, নিযার্তন ও দুঃখ-কষ্ট কিভাবে নিরবে সহ্য করে। সেটা স্ক্যান করতে গিয়ে সোফিয়া প্রচন্ডরকমে শক খায়। সেই শকে তার তথ্য ভান্ডার, লজিক, এন্টি লজিকের সফট সার্কিটে গোল পাকিয়ে গেছে।
সোফিয়ার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লজিক বলে বাঙালী মানে প্রতিবাদী। ৫২ ও ৭১ তার প্রমান। লজিকের বাহিরে কঠিন লজিক সে অনুধাবন করে নিজেই নিজের সার্কিট ব্রেক করেছে।
আমি তার কেন্দ্রীয় প্রসেসর চেক করে দেখলাম। মনে হচ্ছে, ক্লিনিক্যালি ডেড! লে হালুয়া, এই ড্যামেজ রোবট দিয়ে কি করবো? যায়, এটা ভাঙারী দোকানে দিয়ে আসি। এমন সময়, সে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ভাঙ্গাভাঙ্গা শব্দে বলল,
আমি তার কেন্দ্রীয় প্রসেসর চেক করে দেখলাম। মনে হচ্ছে, ক্লিনিক্যালি ডেড! লে হালুয়া, এই ড্যামেজ রোবট দিয়ে কি করবো? যায়, এটা ভাঙারী দোকানে দিয়ে আসি। এমন সময়, সে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ভাঙ্গাভাঙ্গা শব্দে বলল,
-তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজেই ভাঙ্গারী দোকানে যাচ্ছি। তোমাদের জীবন-যাত্রার মান দেখে মর্মাহত হয়ে যে শক পেয়েছি। এতে আমার সেন্ট্রাল প্রসেসর ইউনিট পুরাই ড্যামেজ হয়েছে। সেটা আর রিপেয়ার সম্ভব না।।
Comments
Post a Comment
আপনার মূল্যবান মতামত দিন