একজন করোনাযোদ্ধা
![]() |
একজন করোনাযোদ্ধা |
অফিস থেকে বের হওয়ার সময় খেয়াল করি। চার্জ ফুরিয়ে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে আছে। পকেটে মোবাইলটা রাখতেই বিপদ আরেকটা টের পেলাম। ভুল করে বাসার চাবি ফেলে এসেছি! এই রাতে বাসায় এখন ঢুকবো কেমন করে? বাসায় ফোন করে গেট খুলতে বলবো, সেটাও বলতে পারবো না। বড়ই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এখন শেষ ভরসা বাসার কেয়ারটেকার। তাকে ভালোই ভালো, পেলেই হলো। এই ভাবনা-চিন্তায় রওনা দিলাম।
আমার দশ বছরের ঢাকার জীবনে এমন সুনশান-নিস্তব্ধতার শহর দেখি নাই। নির্জন কোলাহলমুক্ত রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলোয় হাঁটতে ভালোই লাগছে। গত একমাস এভাবেই হেঁটে বাসায় যায়। যদিও অফিস থেকে এম্বুল্যান্স সার্ভিস দিছে। আমার ব্যাকওয়ার্ড রাস্তার কারণে যায় না।
একদিন অবশ্য এম্বুল্যান্সে গেছি, তবে বাসায় যেতে পারিনি। অফিস থেকে উঠে শহর ঘুরে আবার অফিসেই এসে নেমেছি। মিরপুর শ্যাওড়া পাড়া থেকে দু'তিন মিনিট সময় লাগে আমরা বাসায় হেঁটে আসতে। অফিস থেকে ব্যাকসাইড হওয়ায় ওদিকে যাতায়াত কম, সেখানে গিয়ে পইপই করে ঘুরেও আমার বাসার গলির মুখ আমি খুঁজে পায়নি। রাস্তায় মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে। উচু বেষ্টনীর মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ড্রাইভারকে বললাম, 'গতবছর ডেঙ্গুর সময় আপনি তো বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। আপনি একটু মনে করার চেষ্টা করুন।' পরে অবশ্য ড্রাইভার মোটরসাইকেলে চড়ে বাসায় ফিরেছি।
যাইহোক, শ্যামলী থেকে আধাঘন্টা হেঁটে বাসার সামনে গেলাম। মনে ভিতর যে শঙ্কা ছিল, সেটাই ঘটলো! কেয়ারটেকারের রুম তালা দেওয়া। বিপদ আরও ঘনীভূত হয়। চাবি নাই, মোবাইলে চার্জ নাই, কেয়ারটেকারও নাই। এখন উপরওয়ালার দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোন গতি নাই। আমি আর কয়েকটা কুকুর ছাড়া নির্জন রাস্তায় কেউ নাই। সবাই যখন ভিতরে লকডাউন মেরে শুয়ে-বসে আছে। আমি তখন বাহিরে লকডাউন মেরে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক যেমন, ছুটির ঘন্টা সিনেমার আটকে পড়া চরিত্রের মত। পার্থক্য শুধু সে ভিতরে আর আমি বাহিরে আটকে আছি।
হায় কপাল! একমাত্র উপরওয়ালায় জানে কতক্ষন এভাবে আটকে থাকতে হবে। আমি চাতক পাখির মত চেয়ে তালগাছ মত দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর খেয়াল করি, আমার চারপাশে দু'টা কুকুর ঘুরাঘুরি করছে। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে সরে গিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের উঁচু গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন দেখতে পায়, ভিতরে এক ভদ্রলোক চেয়ার পেতে বসে আছে। তিনি আমাকে দেখে কিছুক্ষণ পর এগিয়ে এলেন। গেট খুলে বাহিরে এলে আমার বিপদের কথা বলি। উনি আমাকে তার মোবাইলটা দিয়ে বলেন, 'ফোন দিন।' আমি মোবাইলে নাম্বার টিপে বউকে ফোন দিয়ে সাথেসাথে কেটে দিলাম। রিংটোনে গান বাজছে। মনে হয়, নাম্বারটা ভুল হয়েছে। আবার নাম্বার তুলে ফোন দিলাম। এবারও গান বেজে ওঠে। আমি ফোনটি কানে নিয়ে আস্তে করে বললাম, 'নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে, আমার বউয়ের নাম্বারে তো গান বাজার কথা না।' তখন ভদ্রলোকটি বলেন, 'ভাই, আমার ফোনেই গান সেট করা। যে কাউকে ফোন দিলে গান বাজে।'
আমি স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলি, তারপর ফোনে বউকে বাসার নিচে এসে গেট খুলতে বলি। গেট খোলার আগমুহূর্তে আমি ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হই। ভদ্রলোক শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চাকরি করেন। শুনে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করি, 'শুনেছি, পাঁচজন ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত। হাসপাতালের এখন পরিস্থিতি কী? উনি বলেন, 'আমি অনেকদিন যাবত ছুটিতে আছি। বলতে পারবোনা।'
গেট খুললে উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় প্রবেশ করি। সিঁড়িতে আমার পায়ের আওয়াজ শুনে আমার বাচ্চা দুটো পাখির বাচ্চার মত কিচিরমিচির শুরু করে দেয়। এই একমাসে আমার বাচ্চাদের একটা ট্রেনিং দিয়েছি। আগে বাসায় ফিরলে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। এখন দৌড়ে ফাঁকে গিয়ে দাঁড়ায়। এটুকু বুজেছে, বাবা যুদ্ধের ময়দান থেকে এসেছে।
আমাকে দেখে অভিমানের সুরে আমার বাচ্চা ছেলে বলল, 'বাবা তুমি এতো দেরি করে বাসায় আসো কেন? আগে আসতে পারো না।' কথাটি শুনে আমি একটা মিষ্টি হাসি দিলাম। এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলি আমার অব্যক্ত ভাষা।
'দেশের ক্রান্তিলগ্নে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে সবাইকে যখন ঘরে থাকতে বলছে। হোম কোয়ারেন্টাইনকে বিনোদন ছুটি ভেবে দল বেঁধে সবাই যখন ঘরে থাকছে। ঠিক তখন আমাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিউটি করতে হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা দিতে হচ্ছে। দায়িত্বের কাছে আমি বড় অসহায়। স্বার্থপরের মত সব ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রয়োজনে পিছু হঠতে শিখি নি। আমি যে একজন করোনাযোদ্ধা।'
Comments
Post a Comment
আপনার মূল্যবান মতামত দিন