করোনায় ডাক্তারের মৃত্যু

করোনায় ডাক্তারের মৃত্যু


আপনাকে নিয়ে এভাবে লিখবো! তা কখনো ভাবিনি। আপনাকে নিয়ে যখন লিখছি, তখন আমিও যুদ্ধাহত সৈনিকের মত কোঁকড়াচ্ছি। মরনঘাতি এই করোনাযুদ্ধে আপনি দ্বিতীয় শাহাদাত বরণকারী ডাক্তার। আপনি অসম্ভব একজন কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। এই যুদ্ধে বীরের মত লড়েছেন, এক ল্যাবরেটরি থেকে ছুটে আরেক ল্যাবরেটরিতে গেছেন। অনেক ডাক্তারই যখন নিজেকে গুটিয়ে ঘরবন্ধী হয়ে আছেন, তখন আপনি নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে  ছুটে বেরিয়েছেন, স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন। মহান আল্লাহপাক আপনাকে জান্নাতবাসী করুক।

স্যার, আপনাকে খুব মিস করছি। আপনার সাথে আমার কর্মজীবনের প্রায়ই একযুগের সম্পর্ক ছিল। আমার সৌভাগ্য বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান একজন হেমাটোলজিস্টের (রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ) সাথে আমি কাজ করতে পেরেছি। আমার মত একজন নন-মেডিকেল পার্সনকে আপনি হাতে ধরে মেডিকেল বোদ্ধা বানিয়েছেন। আপনার সাথে কাজ করে আমি অনেক কিছু শিখেছি, রক্তরোগের খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানতে পেরেছি। এখন Complete Blood Count সংক্ষেপে CBC রিপোর্ট দেখে আমি বলে দিতে পারি, রুগীর শরীরের কী কন্ডিশন!

আপনি অনেক বড়মাপের একজন মানুষ ছিলেন। অনেক বড় মনের মানুষও ছিলেন, সেটা সবাই জানে। আপনার ছিলনা কোন দম্ভ অহংকার। একসাথে কাজ করতে গিয়ে কোন সমস্যা হলে আমার সাহায্য চাইতে আপনি কোন কার্পণ্য করেননি। কম্পিউটারের সিবিসি রিপোর্টের মেশিন কাউন্টের সাথে আপনার স্লাইডের অণুচক্রিকাগুলো (Platelet Count) না মিললে আমাকে তাৎক্ষণিক বলতেন, 'কবির দেখতো প্লাটিলেট বেশি মনে হচ্ছে?' আমি স্লাইড দেখে বলতাম, 'হ্যাঁ প্লাটিলেটগুলো বড়বড়, তাই মেশিন কাউন্ট করতে পারেনি। প্লাটিলেট নরমাল করে দেওয়া যেতে পারে।' আপনি সাথেসাথেই ডিসিশন দিয়ে দিতেন।

গতবছর ডেঙ্গুর সিজনে প্রচন্ডরকম কাজের চাপ সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছি। আমি সকাল ৯ টা থেকে রাত ১/২ টা পর্যন্ত ডিউটি করছি। আপনিও দুপুরে এসে সকল কাজ ক্লিয়ার করে আবারও রাত বারোটা/একটার সময় আসতেন। সবাই অফিস থেকে চলে গেলেও আমরা অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতাম। একসাথে ডেঙ্গুর মহামারি মোকাবিলা করেছিলাম।

কিছুদিন আগে, আপনি আক্ষেপ করে আমাকে  বলেছিলেন, 'আমি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করি, রুগি দেখি। তাই আমি বাসায় গিয়ে রুমে ঢুকিনা, ড্রয়িংরুমের গোছল করে এককোণে থাকি। আমার দুটা নাতনিকে আমি কোলে নিতে পারিনা।' একথা শুনে আমিও আফসোস করে বলেছিলাম, 'স্যার আমারও একি অবস্থা। আমার দুটি বাচ্চাকে আমি কোলে নিতে পারিনা। ওদের থেকে দুরে থাকি।'

স্যার কর্নেল প্রফেসর ডা মো মনিরুজ্জামান, আপনার মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি। চোখ বুজতেই কেঁপে কেঁপে উঠেছি। স্মৃতির মানসপটে শুধু আপনার মুখখানি ভাসছিল, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। আপনার মুখের চিরচেনা শব্দগুলো কানে বাজছিল। আমার সাথে দেখা হলে আপনি মিষ্টি করে হেসে বলতেন, 'ও কবির, কেমন আছো?'

সত্যি বলছি, স্যার এখন আমি ভালো নেই। ভালো থাকতে পারছিনা। আমার মনের জোর থাকলেও শরীরের জোর কমে যাচ্ছে। হতে পারে এটাই আমার শেষ পোষ্ট। চোখের সামনে কতো গুলো মৃত্যু আমাকে থামিয়ে দিচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, মৃত্যুর সাথে কথা বলছি, বলছি আমি আসছি হে জীবন ধ্বংসকারী! সকল আনন্দ বিনষ্টকারী! আমি আসছি...

Comments

জনপ্রিয় ব্লগসমূহ

ইবলিশ শয়তান

প্রিপেইড মিটার বিড়ম্বনা

একটি চশমা ও কলমের গল্প

আলাদিনের দৈত্য

কাঙ্গালি ভোজ

মুরগী কবির

জন্মদিনের সারপ্রাইজ

এ তালা ভাঙবো কেমন করে

কাছে আসার গল্প

ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ